ঢাকা : বাংলাদেশের ক্রিকেটের উত্থানের নায়ক বলা হয় মাশরাফী বিন মোর্ত্তজাকে। তার নেতৃত্বেই বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল, চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল খেলেছে টিম টাইগার্স। তখন ক্রিকেটার মাশরাফীর জনপ্রিয়তাও ছিল আকাশচুম্বী। তার বিনয়, বাচনভঙ্গি মুগ্ধ করেছিল কোটি ভক্তদের। ক্রিকেটাররা বরাবরই পাশে পেয়েছেন তাকে। কিন্তু কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে ঘটে যাওয়া অরাজকতার সময়ে ছাত্রদের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায়নি চিরচেনা তাকে। সহস্রাধিক প্রাণহানি, রক্তপাতের পরও আড়ালেই ছিলেন তিনি। চুপ ছিলেন সরকার পতনের পরও।
এই পাশে না থাকার কারণে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তাকে অনেকেই শূলে চড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। গত এক মাসে এত ঘটনার পরও চুপ ছিলেন তিনি। অবশেষে মুখ খুলেছেন তিনি। কথা বলেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ডিজিটাল গণমাধ্যমের সঙ্গে। আলাপকালে তিনি জানিয়েছেন, মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। নিজেকে পুরোপুরি ব্যর্থ বলে দাবিও করেন তিনি।
দেশের তরুণদের একসময়ের আইডল মাশরাফী হতাশ কণ্ঠে বলেন, ‘এই কষ্ট হয়তো আজীবন থাকবে। দেশের একটা ক্রাইসিস মুহূর্তে পাশে থাকতে পারিনি, কিছু করতে পারিনি, এটা আমাকে সব সময়ই ভোগাবে, পোড়াবে। সব সময়ই থেকে যাবে। সব সময় সব কথা বলা যায় না। কিছু জিনিস হয়তো বলার ব্যাপারও নয়। এত দিন চুপ ছিলাম। আজকে কিছু বলছি। কিছু হয়তো সামনে বলব। জীবনে অনেক কিছু হবে। তবে এই কষ্টটা রয়ে যাবে। যত কিছুই হোক, এটা কখনো যাবে না। নিজের ওপর সেই হতাশা সব সময়ই থাকবে।’
তাহলে চুপ ছিলেন কেন? জানতে চাইলে তিনি নিজেকে ব্যর্থ দাবি করে বলেন, ‘এখন আসলে এসব কথার উত্তর বা ব্যাখ্যা দেওয়ার অর্থ নেই। যদি সরাসরি বলি, তাহলে অবশ্যই আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি অনেক মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে। কথা যদি বলতেই হতো তখন... কোটা সংস্কারের আন্দোলন অবশ্যই যৌক্তিক ছিল। আমার নিজের কাছেও মনে হচ্ছিল, এটা হয়ে যাবে। তবে সবাই যখন চাচ্ছিল যে আমি কিছু একটা বলি বা স্ট্যাটাস দিই (ফেসবুকে)... ততক্ষণে আসলে সবকিছু এত দ্রুত হচ্ছিল... ভাবছিলাম যে আমি যদি কিছু লিখি বা মন্তব্য করি, সেটার সম্ভাব্য পরিণতি কী হতে পারে... অনেক কিছু ভাবছিলাম আর কী... সব মিলিয়ে কিছু লেখা হয়নি।’
তবে মাশরাফী চেষ্টা করেছিলেন দাবি করে বলেন, ‘আমি কিছু করার চেষ্টা করিনি, তা নয়। আমি শুধু কিছু লেখার ভাবনায় থাকতে চাইনি। চেয়েছিলাম ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলতে, আলোচনার মাধ্যমে কিছু করা যায় কি না। সেই শুরুর দিকেই চেষ্টা করেছি। কারণ তাদের দাবি আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়েছে। কিন্তু সেটাও করতে পারিনি। সব মিলিয়ে অবশ্যই ব্যর্থ হয়েছি।’
ব্যর্থতার কারণ জানতে চাইলে মাশরাফী বলেন, ‘দেখুন, আমি ছোট থেকে ক্রিকেট খেলেছি, একসময় জাতীয় দলে এসেছি, পরে অধিনায়ক হয়েছি। অধিনায়ক থাকার সময় দল যখন হেরেছে বা খারাপ করেছে, সেটার দায় আমাকে নিতে হয়েছে। আমি সব সময়ই নিয়েছি। আপনারা যদি মনে করতে পারেন, ম্যাচ হারলে অধিনায়ক হিসেবে আমি দায় নিয়েছি। কিন্তু রাজনীতির আঙিনা তো ভিন্ন।’
মাশরাফী যোগ করেন, ‘রাজনীতির মাঠে আমি আমার দলের অধিনায়ক নই। সহ-অধিনায়ক নই। এমনকি, বড় কেউও নই। মাত্র কয়েক বছর হলো শুরু করেছি রাজনীতি। আমি আমার জায়গা থেকেই চেষ্টা করেছি। যতটুকু সাধ্য ছিল, চেষ্টা করেছি যেন ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারি। কিন্তু সুযোগটা না পেলে তো কিছু করার থাকে না। হয়তো দলের উপদেষ্টামণ্ডলীতে থাকলে বা সে রকম কেউ হলে দায়িত্ব পেতাম। তারপরও সাধ্যমতো করেছি, কিন্তু সুযোগটা আমি পাইনি।’
তবে কাউকে দোষারোপ করতে চান না মাশরাফী, ‘তারপরও কাউকে দোষ দেব না। দায় আমারই। বিশেষ করে, মানুষের যে আবেগ-ভালোবাসার জায়গা ছিল, ক্রিকেটার মাশরাফীর প্রতি যে দাবি ছিল, সেটা পূরণ করতে পারিনি এবং সেই দায় মাথা পেতেই নিচ্ছি। আমি ব্যর্থ হয়েছি এবং সেটা আমাকে সেই শুরু থেকেই পোড়াচ্ছে। রাজনীতিবিদ হিসেবে, আমি কিছু করার চেষ্টা করেছি। পারিনি।’
জাতীয় দলে থাকাকালে ক্রিকেটার মাশরাফীর ভক্ত ছিলেন সবাই। রাজনীতিতে এলেও সব মহলে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল। কারণ আজ পর্যন্ত বিরোধীপক্ষকে কটাক্ষ করে কোনো মন্তব্য তার কণ্ঠে শোনা যায়নি। আর সে কারণে অনেকের প্রত্যাশা ছিল দলীয় আবরণের বাইরে গিয়ে মাশরাফী কিছু বলবেন বা করবেন।
কিন্তু সেটা না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সংসদের সাবেক এই হুইপ বলেন, ‘দলের বাইরে গিয়ে কিছু করতে হলে আমাকে পদত্যাগ করতে হতো। সেটা যদি করতাম, তাহলে এখন নিশ্চয়ই আমার অনেক প্রশংসা হতো। কিন্তু প্রতিটি সময়ের বাস্তবতা আলাদা থাকে। ওই সময় যদি পদত্যাগ করতাম, তাহলে আরও বড় কিছু হয় কি না বা পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় কি না, এ রকম অনেক কিছু ভাবতে হয়েছে। আমি যদি সেই ভাবনাগুলো সব তুলে ধরি, সেটারও পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকবে। কিন্তু সম্ভাব্য পরিণতি বা অনেক দিক ভাবতে হয়েছে আমাকে।’
তিনি যোগ করেছেন, ‘নড়াইলের মানুষের কাছেও আমার দায়বদ্ধতার ব্যাপার ছিল। নড়াইল-২ আসনের মানুষের অনেক আশা আমাকে ঘিরে। তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, নড়াইলকে একটা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করব। সেই মানুষগুলোর কাছে কী জবাব দেব? এ রকম নানা কিছু ভাবতে হয়েছে। অনেকেই আমাকে তখন বলেছেন, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে একটি স্ট্যাটাস দিলেও দেশের মানুষ খুশি হবে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমার দায়িত্বটা আরও বেশি। আমি যদি ছাত্রদের কাছে যেতে পারতাম, তাহলে হয়তো এটা সমাধান করা বা কিছু করার সুযোগ থাকত। ছাত্ররা যদি আমার আহ্বানে সাড়া না দিত বা আমাকে গুরুত্ব না দিত, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু নিজের কাছে অন্তত পরিষ্কার থাকতে পারতাম যে, কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছি। সেটা চেষ্টা করেও পারিনি। আগেই বলেছি, ব্যর্থ হয়েছি এবং দায় নিচ্ছি।’
ক্রিকেট খেলেই পরিচিতি পেয়েছিলেন মাশরাফী। প্রথাগত রাজনীতিবিদ তিনি ছিলেন না। যদিও এই মুহূর্তে তিনি আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক। তবুও রাজনীতিতে তার ভবিষ্যৎ কী তা ভাবলেও জানেন না কী করবেন। তবে ক্রিকেট ক্যারিয়ার নিয়ে একটা ভাবনা তার ছিল। তবে আপাতত সেটাতেও আনতে হচ্ছে পরিবর্তন।
এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলি না। বিপিএল খেলি আর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ খেলি। ভেবেছিলাম, আর এক মৌসুম খেলে হয়তো বাদ দেব। এখন যে পরিস্থিতি, তাতে আদৌ বিপিএল হয় কি না বা ঢাকা লিগ হয় কি না, কে জানে। সময় হলে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।’
সাংসদ হওয়ার পর থেকেই তাকে অনেকে বোর্ডে দেখতে চেয়েছিলেন। এই বছরের শুরুতে নাজমুল হাসান পাপন যখন ক্রীড়ামন্ত্রী হলেন, তখন তাকে বোর্ড সভাপতি করারও দাবি উঠেছিল। তবে মাশরাফীর পক্ষ থেকে কখনোই এমন কিছু শোনা যায়নি।
এখনো সেখানেই অনড় আছেন তিনি, ‘আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পর খেলা বাদ দিয়ে ক্রিকেট বোর্ডে যাইনি সাধারণত। নিজের কথা আসলে ভাবিনি। যে জায়গায় আমি ছিলাম, হয়তো ওপরের মহলে গিয়ে বলতে পারতাম যে ক্রিকেটে এই কাজটা করতে চাই বা ওই দায়িত্ব নিতে চাই। কিন্তু নিজের কথা বলতে চাইনি কখনোই। যখন বলার সুযোগ ছিল, তখনই বলিনি। এখন যে পরিস্থিতি, আমার কাছে মনে হয়, ক্রিকেট বোর্ডে থাকা বা এ রকম কোনো দায়িত্ব আমার প্রাপ্য নয়। আমি দাবিও করতে পারি না।’
বোর্ডে থাকার বাস্তবতা এই মুহূর্তে নেই, ডিজার্ভও করেন না দাবি করে মাশরাফী বলেন, ‘যখন রাজনীতিতে ছিলাম, ক্রিকেট বোর্ডে থাকার চেষ্টা করিনি। এখন রাজনীতিতে নেই, এখন যদি বোর্ডে থাকার চেষ্টা করি বা থাকতে চাই, তাহলে কেমন হয়ে যায় না! যদি ছোট কোনো প্ল্যাটফর্মে সুযোগ আসে, সেই জায়গা থেকে চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু বড় পরিসরে বা বোর্ডে গিয়ে বলব, এখন কাজ করতে চাই ক্রিকেট নিয়ে, এটা অনেকটা সুযোগসন্ধানী ব্যাপার হয়ে যাবে। এই জায়গা থেকে আমার মনে হয়, এটা আমার প্রাপ্য নয়। হ্যাঁ, ক্রিকেট আমার রক্তে আছে। কেউ কখনো সহায়তা চাইলে অবশ্যই পাশে থাকব। কিন্তু বোর্ডে থাকার বাস্তবতা এই মুহূর্তে আমার নেই। ডিজার্ভও করি না।’
এমটিআই