ঢাকা: সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন সাকিব আল হাসান।
তবে মাত্র ৭ মাসের মাথায় গণ আন্দোলনের মুখে পতন হয় সেই সরকারের। সাকিবকেও খোয়াতে হয় সংসদ সদস্যের পদ।
ছাত্রদের আন্দোলনে নীরব থাকায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন জাতীয় দলের সাবেক এই অধিনায়ক। জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে হওয়া ছাত্র-জনতা আন্দোলনে নিহত হওয়া গার্মেন্টসকর্মী রুবেল হত্যা মামলায় আসামি হিসেবে নাম উঠে আসে তার। ভারতের মাটিতে টেস্ট সিরিজ চলাকালে ক্রিকেটের এই বনেদি ফরম্যাট ও টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মিরপুরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্ট খেলে ইতি টানতে চেয়েছিলেন। সে জন্য ফেসবুকে ছাত্র আন্দোলনে নীরব ভূমিকা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে দীর্ঘ এক পোস্টও করেছিলেন।
গল্পের শেষ অধ্যায়ে সবাইকে পাশে চেয়ে বলছিলেন, ‘ক্রিকেটের এই গোটা গল্পটা আপনাদের হাতেই লেখা! তাই আমার শেষ ম্যাচে, এই গল্পের শেষ অধ্যায়ে, আমি আপনাদেরকে পাশে চাই। আমি আপনাদের সবাইকে সাথে নিয়ে বিদায় নিতে চাই।
বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর হাতে হাত রাখতে চাই, যাদের হাতের তালি আমার ভালো খেলতে বাধ্য করেছে। বিদায়বেলায়, সেই মানুষগুলোর চোখে চোখ রাখতে চাই, আমার ভালো খেলায় যাদের চোখ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়েছে।’
কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক হয়, বিদায়ী টেস্ট ম্যাচ খেলতে দেশে আর ফিরতে পারেননি সাকিব। তীব্র আন্দোলনের মুখে দুবাই থেকে ফেরত চলে যেতে হয়েছে।
এক প্রতিক্রিয়ায় তখন তিনি বলছিলেন, ‘কোথায় যাব, জানি না। তবে এটা প্রায় নিশ্চিত যে আমি দেশে ফিরছি না।’ ভারতের বিপক্ষে খেলা টেস্ট সিরিজই সাকিবের আপাতত জাতীয় দলের হয়ে খেলা শেষ ধরে নেওয়া যায়। এরপর বেশ কয়েকবার গুঞ্জন উঠলেও দলে আর ফেরা হয়নি।
এর মধ্যে ক্রিকেটের বাইরে সাকিবের ব্যক্তিগত জীবনেও ঝড় বয়ে যায়। শেয়ার বাজারে জালিয়াতির অভিযোগে জরিমানার মুখে পড়েছেন এমনকি তার এবং তার স্ত্রীর ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। যে কারণে ‘বিদেশে অবস্থানরত সাকিব লেনদেন করতে সমস্যায় পড়ছেন, বিসিবিকে অনুরোধ করেছেন সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে’-গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এমন দাবিও করা হয়েছে।
জাতীয় দলের দুয়ার বন্ধ হয়ে যাওয়া সাকিবের জন্য শেষ ভরসা হয়ে ছিল ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। কিন্তু আসন্ন আইপিএলের মেগা নিলামের চূড়ান্ত পর্বে নামই তোলা হয়নি তার। অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতেও তেমন একটা ভালো ফর্মে ছিলেন না।
কাউন্টিতে কলঙ্কের কালিমা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষে পাকিস্তান সিরিজ দিয়ে আবারও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফিরেছিলেন সাকিব। পাকিস্তানের মাটিতে ইতিহাসগড়া টেস্ট সিরিজ জয়ের পর টাইগারদের পরের চ্যালেঞ্জ ছিল ভারত সিরিজ। ভারতের বিপক্ষে সিরিজ সামনে রেখে মিরপুরে প্রস্তুতি সেরেছিল বাংলাদেশ দল।
সাকিব তখন উড়ে গিয়েছিলেন ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে। টনটনে সমারসেটের বিপক্ষে সারের হয়ে চারদিনের ম্যাচ খেলেই আবারও জাতীয় দলের ক্যাম্পে ফিরবেন এমন কথাই ছিল।
১৩ বছর পর কাউন্টি ক্রিকেটে ফেরাটাও রাঙিয়েছিলেন দারুণভাবে। দুই ইনিংস মিলিয়ে সাকিব শিকার করেন ৯ উইকেট। তবে ম্যাচ শেষ হতেই দুঃসংবাদ পেতে হয় তাকে। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের অভিযোগ ওঠে সাকিবের বিরুদ্ধে।
সাকিবের বোলিং অ্যাকশন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন ম্যাচের দুই আম্পয়ার। বলা হয়েছিল, ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট বা কাউন্টিতে খেলতে হলে বোলিং অ্যাকশন পরীক্ষায় উৎরাতে হবে সাকিবকে। যে কারণে এ মাসের শুরুতে বোলিং অ্যাকশনের পরীক্ষা দেন সাকিব। সেই পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি তিনি।
ফলে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) অধীনে কোন ঘরোয়া টুর্নামেন্টে বোলিং করতে পারবেন না সাকিব। বার্মিংহ্যামের লাফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ১৫ ডিগ্রির বেশি কনুই বাঁকানোয় এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সাকিবকে।
সেটি থেকে মুক্ত হতে সাবেক এই বিশ্বসেরা অলরাউন্ডারকে আবারও পরীক্ষায় বসতে হবে। তবে ঘটনা এখানেই শেষ নয়। ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের এই সিদ্ধান্তের ডোমিনো ইফেক্ট আরও বড়। আইসিসির নিয়মের প্যাঁচ বলছে, সাকিবের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারেও পড়বে এর ধাক্কা।
বাংলাদেশের জার্সিতেও বোলিং করার ক্ষেত্রে সাকিব আল হাসান পড়বেন বাধার মুখে। ‘আইসিসি রেগুলেশন্স ফর দ্য রিভিউ অব বোলার্স রিপোর্টেড উইথ সাসপেক্ট ইলিগ্যাল বোলিং অ্যাকশনস’ আইনে আটকে যাচ্ছেন সাকিব।
আইনের ১১.৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘একটি জাতীয় ক্রিকেট ফেডারেশন যদি কোনো বোলারকে তাদের নিজস্ব নীতিমালার অধীনে ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষিদ্ধ করে এবং সেই নিষেধাজ্ঞা যদি স্বীকৃত পরীক্ষাগারে মানসম্মত বিশ্লেষণ-বিধি অনুযায়ী করা হয়, তাহলে সেই নিষেধাজ্ঞাকে আইসিসি আমলে নেবে এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আরোপ করবে।’
একই অনুচ্ছেদের শেষদিকে বলা হয়েছে, ‘অতিরিক্ত কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া সব জাতীয় ক্রিকেট ফেডারেশন এবং তাদের অধীনস্থ ঘরোয়া ক্রিকেটেও একই নোটিশ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে। আইসিসি এবং জাতীয় ক্রিকেট ফেডারেশনগুলো সিদ্ধান্ত আরোপ ও কার্যকরের জন্য সব পদক্ষেপ বিধিসম্মতভাবে নেবে।’
যার অর্থ, আগামী দিনগুলোতে সাকিবকে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগে নাও দেখা যেতে পারে। এমনটাই যদি হয়, তবে সাকিবের ক্যারিয়ারই প্রায় শেষ বলা চলে। কারণ, চোখের সমস্যার কারণে প্রায় ১ বছর ধরেই সাকিবের ব্যাটে ধার নেই। বোলিংটাই ছিল তার কার্যকরী অস্ত্র। এবার সেই অস্ত্রেও ধরা পড়ল ত্রুটি।
এআর